পেটুক আবার দার্জিলিঙে

গতবার দার্জিলিং ট্যুরে খাওয়া দাওয়া নিয়ে আমাদের এক্সপেরিমেন্ট চলেছিল ভালোই আর সেই এক্সপেরিমেন্টের শুরুটা হয়েছিল হাওড়া ষ্টেশন থেকেই। রাতের ট্রেন হলে সাধারণত বাড়ি থেকেই ডিনার প্যাক করে নিয়ে যাওয়া হয়, মাংসের সাথে লুচি বা পরোটা, কিন্তু সেবার তা করা হয়নি। সেবার হাওড়া স্টেশনে কেএফসি’এর এসিতে বসে রাতের খাওয়াটা সেরে নিয়েছিলাম নিশ্চিন্তমনে আর প্যাক করে নিয়েছিলাম চিকেন পপকর্ন, পরে মুখ চালানোর জন্য, সে রাতের মতন নিশ্চিন্ত।

aaa4.jpg

 NJP-এর বাইরে কোনো ভালো খাবার দোকান নেই, ওই আটা দিয়ে বানানো পুরি-সব্জি, ভাত আর মাছ/ মাংস বা ফ্রাইড রাইস চিলি-চিকেন; তাই সময় নষ্ট না করে শিলিগুড়িতে নমো নমো করে চা বিস্কুট খেয়েই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। ঘন্টা দুয়েকের রাস্তা পেড়িয়ে সোজা গিয়ে থেমেছিলাম  Kursiong Tourist Lodgeএ । সেখানকার বিখ্যাত এবং রোমান্টিক ডাইনিং রুমে আরাম করে বসে পাহাড় দেখতে দেখতে সেরে নিয়েছিলাম পেট পূজো, গরমাগরম আলুর পরোটা, টক দই আর চিকেন মোমো সহযোগে। 

সেখান থেকে ধিরে সুস্থে বেড়িয়ে সোজা দার্জিলিং, আরো ঘন্টা দুয়েকের ড্রাইভ তারপর কিছুটা হেঁটে, লাঞ্চের আগেই পৌঁছে গেছিলাম Darjeeling Tourist Lodge। সেদিন আর কোনো রকম চান্স না নিয়ে অর্ডার করেছিলাম সেই চিরাচরিত মেনু, ভাত, ডাল, ঝুরি আলুভাজা আর চিকেন কারি; ছিমছাম, পেট ভরন এবং মন ভরন।

পরের দিনের ব্রেকফাস্টটা দার্জিলিং ট্যুরিস্ট লজের ডাইনিং রুমে সেরেছিলাম – এদের ডাইনিং এরিয়াটাও বেশ ছিমছাম এবং সুন্দর করে সাজানো। ডাইনিং-এর যেদিকে কাঁচের জানালাগুলো আছে সেদিকেই দারুণ সুন্দর ফুলের বাগান করা, আকাশে মেঘ না থাকলে বাগানের দিকেই দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। সকালের নরম রোদটাও আসে ওদিক দিয়েই, সেই রোদ গায়ে মেখে ফুলের বাগানের পাশে বসে দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে প্রাতঃরাশ করার মনোরম অভিজ্ঞতাটাও মনে থেকে যাওয়ার মতনই।   

নেহেরু রোড বরাবর আর আস্তাবলের সামনেটা অনেক মানুষ – অধিকাংশই মহিলা, বিকালের পর অস্থায়ী দোকান বসায় খাবারের। ফুচকা, ঘুগনি, চাট, ভেলপুরি থেকে শুরু করে মোমো, চাউমিন, চিলি চিকেন, চিকেন বল, ললিপপ, বার্গার থেকে ড্রামস্টিক, শেফালে, রোল, পকোড়া এমনকি ভুট্টাও পাওয়া যায় সেখানে – পছন্দ মতন খাবার খেয়ে দেখতে পারেন সন্ধ্যেবেলা আর রাতের খাবার সেরে নিতে পারেন কাছের মনপসন্দ যেকোনো রেস্টুরেন্টে।

গান্ধী রোডের টিবেটিয়ান রেস্টুরেন্ট কুঙ্গা এখন বেশ একটা পরিচিত নাম বাঙালি ট্যুরিস্টদের মধ্যে। ছোট্ট একটুকরো এই রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় প্রধানত টিবেটিয়ান আর চাইনিজ খানা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় লাইনে না দাঁড়িয়েই সেবার এবং আশ্চর্যজনক ভাবে এবারেও বসার জায়গা পেয়ে গেছিলাম লাঞ্চের সময়। কুঙ্গার প্রধান আকর্ষন ওদের হ্যান্ডমেড গ্লাস ন্যুডুলসের বা Phing(ফিং)-এর যেকোনো প্রিপারেশান, ওয়ানটন স্যুপ আর বিফ ওয়াইওয়াই তবে এক একটা প্লেটে ওরা যতটা পরিমাণ খাবার সার্ভ করে যে সেটা নিঃসন্দেহে একজনের খাওয়ার পক্ষে বেশি, তাই আমরা কজনে বেশ বুঝেশুনেই অর্ডার করেছিলাম।

প্রথমে একটা করে হানি-লেমন টি অর্ডার দিয়ে আজকের সেরা একটা টিবেটিয়ান ডিশ ওনাদেরকেই রেকমেন্ড করতে বলেছিলাম, সেইমত একটু পরেই হাজির হল বিফ থেনথুক বা একপ্রকার থুকপা যা হ্যান্ড-পুল্ড, ফ্ল্যাট বা চ্যাপ্টা শেপের ন্যুডুলস, সবজি আর মাংস দিয়ে বানানো স্যুপ জাতীয় একটা দারুণ ডিশ। এই হ্যান্ড-পুল্ড ন্যুডুলস, রাউন্ড বা সাধারণ ন্যুডুলসের শেপের হলেই তার নাম হয়ে যায় ভাগথুক। যাইহোক, এই সব কচকচানি ছেড়ে আসল কথায় আসি, থেনথুক উদরস্থ করতে করতেই আমরা এক প্লেট পোর্ক ফিংও অর্ডার করে দিয়েছিলাম, সেটির স্বাদও বলাই বাহুল্য মারাত্মক রকম ভালো ছিল।

এর সাথে পোর্ক মোমোও বলেছিলাম, স্বাদের কথা না বললেও চলবে তবে এই মোমো খাওয়ার একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। একএকটি মোমোর নীচের দিকে ছোট্ট ফুটো করতে হয় দাঁত দিয়ে আর ওই মোমোর ভেতরের স্যুপটা সরাৎ করে চুষে নিতে হয়, এই স্যুপটির স্বাদ আপনার মুখে লেগে থাকবে তবে মোমোর সাথে আলাদা করে কোনো স্যুপ দেন না এরা – বদলে থাকে ডলে দিয়ে বানানো একটা ফ্রেশ লাল চাটনি যা শুধু এখানেই পাবেন।। কুঙ্গার অ্যাম্বিয়ান্সটাও খুব ভালো আর খরচটাও সাধ্যের মধ্যে, সেদিনও ধীরে সুস্থে কয়েকটা নতুন এবং সুস্বাদু প্রিপারেশন খেয়ে তৃপ্ত চিত্তে ফিরে গেছিলাম আস্তানায়।

পেটুক আমি দার্জিলিং আসবো আর Keventers (কেভেনটারস) দর্শন করে পেট পুজো করব না, তা কি হতে পারে! কাজেই পরের দিনের প্রধান গন্তব্য ছিল বিখ্যাত Keventers। মল থেকে ১০ – ১৫ মিনিট মতন হাঁটা রাস্তা তায় নীচের দিকে হাঁটতে হবে, কোনো কষ্টই নেই। কেভেনটারসের ছাদে বসতে বসতে মেনু কার্ড দেখার আগেই একটা করে হট চকোলেট বলে দেওয়া যায়; তারপর, যদি আমার মতন সর্বভুক হয়ে থাকেন তবে অবশ্যই একটা পোর্ক প্ল্যাটার অর্ডার করুন, ওটাই কেভেনটারসের স্টার ডিশ; আপামর বাঙালি থেকে দেশ-বিদেশের অসংখ্য ট্যুরিস্ট এই প্ল্যাটারটাই খেতে আসেন এখানে।

এই পোর্ক প্ল্যাটারে থাকে বেশ কিছু হ্যাম ও সালামির স্লাইস, অনেকগুলো সসেজ, বেকন স্ট্রিপ আর সবার উপর সাজানো থাকে ডবল ডিমের পোচ, সানি সাইড আপ; কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখতে দেখতে এইরকম সুস্বাদু, খাঁটি ইংলিশ ব্রেকফাস্ট সারার মজাই আলাদা, চোখের আর পেটের খিদে একসাথে মেটাবার সেরা ঠিকানা হল এই কেভেনটারস। তবে সর্বভুক না হলেও বিশেষ চিন্তা নেই কারণ পোর্ক ছাড়া আরো অনেক ডিশ পাওয়া যায় এখানে, তার মধ্যে গ্রিল্ড স্যান্ডউইচ আর হট ডগ আমার বেশ প্রিয়।

Keventers অসাধারণ, Glenary’s-ও তাই কিন্তু গতবার আমরা ছিলাম অন্য তালে, টেস্ট বাডের সাথে কম্প্রোমাইজ না করে কম খরচে খাবার আস্তানার সন্ধান করেছিলাম। ডমিনোস আছে এখানে, Mallএই একটা C.C.D-ও আছে, মোটেই বলছিনা ওখানে খান বরং আস্তাবলের রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে ডান হাতে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট চোখে পড়বে, ঢুকে পড়ুন সেটিতে – তিব্বতি এক মা আর ছেলে মিলে চালান এটা।

তিনটে টেবিল আর ছ’টা বেঞ্চ, পাশে রান্নাঘর নিয়ে খুব ছোটো একটা সেটআপ তবে পরিছন্ন এবং উষ্ণ। সবে বসেছি, দেখলাম এক সাহেব গট গট করে এসে ঢুকলেন আর বসলেন আমাদের টেবিলেই, আসলে জায়গা কম হওয়াতে সবাইকেই শেয়ার করতে হয় টেবিল আর বসার স্থান। হাবভাবে বোঝা গেল উনি এখানে নিয়মিত আসেন, তা বেশ তো। Menu Card এর সাথে ওনারা একটা খাতা কলম দেন, যা খাবেন, যাতটা খাবেন তা লিখে দিতে হয় ওই খাতাতেই, গরমা গরম খাবার চলে আসবে আপনার সামনে খুব তাড়াতাড়ি। আমরা সেদিন অর্ডার করেছিলাম বিফ থুকপা আর চিকেন মোমো, অসাধারন টেস্ট এবং বিলকুল পেট-ভরন তাছাড়া ওনাদের হট চকোলেটটা সেরা, আমরা ওনাদের এই হট চকোলেটটাই বেভারেজ এবং এনার্জী ড্রিঙ্ক হিসাবে ফ্লাস্কে ভরে বাকি ট্যুরটা করেছিলাম। তবে দুঃখের বিষয়, এবার গিয়ে আর ওই আস্তানাটি আর খুঁজে পাই নি, সেই জায়গায় গড়ে উঠেছে একটি আস্ত মাল্টিপ্লেক্স।

পাহাড়ে ওঠা ইস্তক উৎকৃষ্ট লিকার চা পান করেছি, WBTDCL-এর প্রপার্টিগুলোতে থাকার অন্যতম সুবিধা হল ওদের কমপ্লিমেন্টরি ব্রেকফাস্ট, উপরি পাওনা দার্জিলিংএর সুগন্ধি বেড টি, আপনার সকালটাকে ঝকঝকে করে তুলবে। গ্লেনারিজ তার বেকিং প্রোডাক্টের জন্য বিখ্যাত তবে খুব ভালো দার্জিলিং-টিও পাওয়া যায় এখানে কিন্তু শুধু চায়ের লিকারে কি চলে সবসময়, অন্য লিকারের প্রয়োজনও পড়ে সময় বিশেষে।

Jailএর মতন F.L. Shop থেকে Liquor কিনতে হয় কলকাতায়, কিছু মল-এ লিকারের আলাদা সেকশান আছে কিন্তু বেশ মজা লাগবে এখানে এসে। Showroomএর মতন liquor shop, মহিলারাও নির্দ্বিধায় আসছেন তাদের পোষা কুকুর নিয়ে, ঘুরে দেখছেন, দোকানীর থেকে ফিডব্যাক নিয়ে নিজের পছন্দের লিকার কিনছেন, no issue, কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। এই চৌরাস্তা ওয়াইন স্টোরের সাথে পুরোনো সম্পর্ক, আমাদের বিবাহবার্ষিকী থাকায় একটা ভালো ওয়াইন কিনেছিলাম সেবার।

তবে এইটুক বললেই সব শেষ হয় না, দার্জিলিংকে চেনা বাকি থাকবে যদি না আপনি দার্জিলিং পোস্ট অফিসের উল্টো দিকে জোই’স পাবে (Joye’s Pub) না যান অথবা জাকির হোসেন রোডে Gatty’s Caffe (গ্যাটির ক্যাফে) বাদ দেন। শেষ বেলায় Joye’s Pub-এর মালিক পুরন গোমবার গিটার আর গানের যুগলবন্দী যেমন ভোলার নয় তেমনই দার্জিলিংএর যে আস্তানা সবচেয়ে রাত পর্যন্ত খোলা থাকে, যেখানে রাতের লিকার আর চায়ের লিকার বা গরম কফি একইসাথে পাওয়া যায়, Gatty’s Caffe (গ্যাটির ক্যাফে), সেখানে রাতের বেলায় কিছু সময় না কাটালেই নয়। গ্যাটির ক্যাফেতে অধিকাংশই বিদেশি মানুষের দেখা পাবেন যারা নিজেদের ট্রেকিংএর অভিগ্যতা শেয়ার করতে থাকেন পেগ হাতে নিয়ে, অধিকাংশই সাফল্যের কাহিনী।

তবে সব সাফল্যের কাহানির সাথেই মিলেমিশে থাকে কিছু ব্যর্থতার কাহানিও। এই যে আমরা বারবার আসি দার্জিলিং কিন্তু তাকে কি পুরোটা চিনতে পেরেছি ? প্রতিবারই কিছু না কিছু বাকি থেকে যায় দেখার, এবার যেমন কুংার পাশের আরেকটা ভালো রেস্টুরেন্ট ডেকেভাস, কোরিয়ান ফুড ট্রাই করতে হবে পরেরবার এসে। তাই বলাই যায় যে থাক না একটু ব্যথর্তা… কিছু বাকি থেকে যাক চেনার বা জানার, আবার একবার আসা যাবে ফিরে …

d2.jpg

6 thoughts on “পেটুক আবার দার্জিলিঙে

  1. Apni ki Kunga er kotha bolchen??? Amrao okhan thekei mixed rice… fried chilli pork… fried beef… chicken thukpa… pork momo… aro koto ki try korechi… onoboddo legechilo… darun taste… promt service.. sudhu khawa noy… ritimoto deshi bideshi der milon khetro bola jay…

    Liked by 1 person

  2. “Kunga” is one of the best place to eat in Darjeeling, highly recommend, amar bar bar Darjeeling jaoyar onnotomo karon “Kunga”.

    Liked by 1 person

Comments are closed.