Bhandara Road (ভান্ডারা রোড – মহারাষ্ট্র)

প্রতি বছরের মতন সেবারেও বড়দিনের সময় হোস্টেল এবং পুরো কলেজ কার্যত ফাঁকা। ভিক্টর বলল ওর আর ভাল লাগছে না এবং একা-একা আমারও একই অবস্থা, কাজেই ঠিক হল আগামীকাল দুজন মিলে ট্রেন ধরব ভিক্টরের বাড়ি যাওয়ার জন্য। ভিক্টর আমার ক্লাসমেট, রুমমেট এবং আমার কলেজ জীবনের সবথেকে ভাল বন্ধু। কাজেই ওর বাড়িতে আমার ছুটি কাটাতে যাওয়া ছিল একপ্রকার সাংবিধানিক অধিকার। যদিও প্রধান অসুবিধা ছিল আর্থিক, তার কারণ ভিক্টরের বাড়ি অধুনা ছত্তিশগড়ের কোরবা আর আমরা ছিলাম ব্যাঙ্গালোরে, দূরত্ব অনেকটা।

ব্যাঙ্গালোর থেকে দুটো জেনারেল টিকিট নিয়ে, ছোট্ট একটা যুদ্ধ করে দুটো সিট যোগাড় করে চড়ে বসলাম ট্রেনে, পকেটে মোটে চারশো টাকা পড়ে আছে আর প্রায় দুদিন ট্রেনে কাটাতে হবে এবার। চেন্নাইতে ট্রেন বেশ দেড়ী করেই ঢুকেছিল, কাজেই কানেকটিং ট্রেন ছুটে যাওয়ার খুবই সম্ভাবনা ছিল। তড়িঘড়ি তাই এই ট্রেন থেকে নেমে ছুট লাগালাম সেই কানেকটিং ট্রেন ধরার জন্য। কোনো এক অজানা কারণে সেদিন সব ট্রেনই ছিল লেট, তাই আমাদের সেই কানেকটিং ট্রেন ধরতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। এরপর বেশ ধ্বস্তাধস্তি করে দুটো বসার যায়গাও দখল করতে পেরেছিলাম যদিও সেটা বসার সিট নয়, তার উপরের মাল রাখার জায়গাতে।

এই ট্রেনে আমরা নাগপুর পর্যন্ত যাব, সালটা ২০০৪, তখন মোবাইলে ক্যামেরা থাকত না কাজেই ছবি তোলার কোনো অবকাশ ছিল না। প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে বাথরুম পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব ছিল না এবং খাবার বলতে ছিল শসা, কলা আর স্টেশন ভেন্ডারদের থেকে কেনা ইডলি। সেইসময় আমরা ট্রেনের বাইরের দুনিয়া থেকে অনেক দূরে ছিলাম, খবরের কাগজও ছিল না হাতে, না ছিল মোবাইলের নেটওয়ার্ক।

প্রচণ্ড খিদেতে বেশ কাতর ছিলাম। নাগপুরে ট্রেন থামতেই ছুট লাগালাম অনুসন্ধান ডেস্কের দিকে। হাতে কিছু সময় আছে জেনে ছুট লাগালাম স্টেশানের বাইরে এবং বন্ধু রাজের (raj deo sing) বলে দেওয়া দোকানে বসে কচুরি ও সিঙ্গারা খয়ে পেটের জ্বালা শান্ত করতে।

খেয়ে-দেয়ে আমাদের নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে এসে তো মাথায় হাত, শয়ে শয়ে লোক, যেন এটা নাগপুর নয় হাওড়া – আর সবাই নাকি আমাদের ট্রেনেই উঠবে। অন্যান্য ট্রেনের মতন এই ট্রেনেও মাত্র চারটেই জেনারেল কামরা কিন্তু দুটো একদম ফাঁকা কামরাও ছিল। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি যাচাই করছিলাম। জেনারেল কামরাগুলো আগে থেকেই পুরো ভর্তি ছিল। অসংখ্য মানুষ সব রকম ভাবে তাতে চড়তে চেষ্টা করছিল, সবাই তাদের লাগেজ মাথায় নিয়ে ওই কামরাতে ঢোকার চেষ্টায় ছিল, তবে মনে হয়না বেশি কেও তাতে সফল হয়েছিল।

পাশের মিলিটারি কামরাতে ছিল মাত্র ৩ জন অর্থাৎ সেখানে আরও ৬৯ জন আরামসে ঘুমাতে পারত বা আরও ১৮০ জন মানুষ আরামসে যেতে পারত। এরকম দুটি কামরাও ছিল অথচ তাতে কেও সওয়ার হতে পারেনি সেদিন। ওই কামরাগুলোর দরজা বন্ধ ছিল, যারা ওই দরজাগুলো খুলতে চেষ্টা করেছিল তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে মেরে প্রতিরোধ করা হয়েছিল এবং আমরা যারা জানালার কাছে ছিলাম তাদের গুলি করার ভয় দেখান হয়েছিল। আমাদের যাওয়াটা জরুরি ছিল তাই আমরা আমাদের দুটো ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে পড়েছিলাম একটা ২য় ক্লাস স্লিপার কামরায়। প্ল্যানটা এরকম ছিলো – যেখানেই ট্রেন খালি হবে আমরা চলে যাব জেনারেলে।

কিন্তু বিধি বাম। সেদিনিই হল ম্যাজিস্ট্রেট চেকিং। চারটে পুলিশ, এক ম্যাজিস্ট্রেট এবং দুজন টিটই ছিল সাথে। আমরা বেচারা দাঁড়িয়ে ছিলাম ২য় ক্লাসের বেসিনের সামনে। আমাদের পাকড়াও করার পর বলা হল ৩০০ x ২= ৬০০ টাকা ফাইন দিন নাহলে মামারবাড়ি চলুন। হতচকিত আমি মামারবাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে প্রায় রাজিই হয়ে যাচ্ছিলাম আর কি – যদি না ভিক্টর আমাকে আটকাত, মামার বাড়ি মানে ওখানেও জেল। দুজনের পকেট হাতড়ে মাত্র ২০০ টাকা বেড়লো, আমরা তাই দিয়েই ফাইন দিতে চাইলাম। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট বাবু একটুও খুশি হলেন না এবং ফাইন না নিয়ে বললেন যে পরের স্টেশানেই আমাদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে। পরের স্টেশনে নামিয়ে দিলে বিলাসপুর যাওয়া মুশকিল হবে জেনে ভিক্টর অনেক কাকুতি মিনতি করেছিল যাতে পরের স্টেশানেই না নামিয়ে ঠিক তার পরের বড়ো স্টেশানে পর্যন্ত যাওয়ায় অনুমতি দেওয়া হয় যাতে নেমে ঠিক ট্রেন ধরতে পারি।

318049_428965630459049_400822486_n

সেটা হল না। আমাদের নামিয়ে দেওয়া হল অজানা এক স্টেশনে। নেমে দেখলাম যে এখানে মাত্র দুটো প্ল্যাটফর্ম, ডানদিকে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেড়নোর রাস্তা আর বাঁ-দিকে স্থানীয় ছেলে-পুলেরা ক্রিকেট খেলছে ধুধু-মাঠে। প্রথময়েই অনুসন্ধান ডেস্কে গেলাম এবং জানতে পারলাম যে পরবর্তী ট্রেন ঘণ্টা সাতেক পরে। তা শুনেই ছুটে বাইরে গেলাম বাস ধরার জন্য। বুকিং কাউন্টারে গিয়ে জানলাম যে বাসের ভাড়া ২০০/-  টাকা প্রত্যেকজনার, আমাদের কাছে সেই পরিমাণ টাকা না থাকতে বাসেও আর ওঠা হল না। অতঃ কিম্, পাশের এক চায়ের দোকানে আয়েশ করে বসে কয়েকটা চা-সিগারেট ধ্বংস করা হল। পরবর্তী ট্রেন সাত ঘণ্টা পড়ে ছিল তাই স্টেশানে ফিরে  দুটো বেঞ্চ খুঁজে নিয়েছিলাম – যাদের উপরে পাখা চলছে এবং ব্যাগ মাথার নীচে রেখে পা ছড়িয়ে  শুয়ে পড়লাম, আহ্‌ , মনে হল কতদিন পর শুলাম। ভেবেছিলাম ঘুম লাগাবো কিন্তু ঘুম আসল না, অতঃপর আমি উঠে প্ল্যাটফর্মের পাশের মাঠে বাচ্চাগুলোর সাথে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠলাম। কিছু পরে ভিক্টরও যোগ দিল আমাদের সাথে। আসলে যতটা খারাপ কাটবে ভেবেছিলাম সেই সাত ঘণ্টা ততটা খারাপ কাটেনি সময়টা এবং অবশেষে চড়েতে পারলাম সেই ট্রেনে যেটা আমাদের বিলাসপুর পৌঁছে দেবে।

তবে ওই পর্যন্তই, জেনারেল কামরাতে এত ভিড় যে কার্যত একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হল প্রায় চার ঘণ্টা, তারপর একটু যায়গা ম্যানেজ করে নিজের তাশ্রিফ-কা-টুকরা রাখতে পেরেছিলাম বাকি তিন ঘণ্টার যাত্রাপথে।

ঘণ্টা সাতেক পর যখন বিলাসপুরএ এসে পৌঁছালাম তখন রাত দশটা বেজে গেছে আর বলতে গেলে দুজনেরই পকেট শূন্য। এখানে নেমে একটা ফোন করার কথা ছিল আর আমাদের কাছে বেঁচে ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। আমি দু টাকা দিয়ে একটা সিগারেট কিনে সুখটান দিলাম আর ভিক্টর এক টাকা দিয়ে একটা শিখর মুখে চালান করে বাকি দু টাকা দিয়ে ফোন করল মনু-কে; মনু(Manish Nayar) ভিক্টরের বাল্যবন্ধু। এরপর মাত্র দশ মিনিট মতন আমরা একটা ফুটপাথে বসে ছিলাম স্টেশনের বাইরে, এমন সময় সামনে উদয় হল একটা নতুন কালো ঝকঝকে স্করপিও গাড়ির, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মনু বলল ” আবে চাড় যা পিছে “। ওই শুরু হয়েছিল আমাদের মস্তি করা। মনু জিজ্ঞেস করল “কেয়া দারু পিয়েগা” এবং আমাদের ফরমাইশ শুনে বন্ধ দোকান খুলিয়ে কেনাকাটা সেরে নিল। সেদিন রাত তিনটে পর্যন্ত আমরা মজা করেছিলাম এবং পরের দিন মনুই আমাদের ড্রাইভ করে কোরবাতে  ভিক্টরের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। কোরবাতে সাত দিন ছিলাম।

পরের সেই সাত দিনের গল্প পরের জন্য তোলা থাক নাহয়…